বাংলাদেশকে আয়ের উৎস বানিয়ে যুদ্ধের খরচ জোগাচ্ছে আরাকান আর্মি

অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশের সঙ্গে লাগোয়া মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। তাদের বাধার ফলে গত সাত মাস ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ স্থলবন্দর কার্যত অচল হয়ে আছে। সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের সুযোগ ব্যবহার করে বাংলাদেশকে অস্ত্র–মাদক কেনাবেচা ও পণ্য চোরাচালানসহ বিভিন্ন অবৈধ কারবারের বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত করেছে প্রতিবেশী দেশের এই সশস্ত্র সংগঠন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা এসব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। অবৈধ বাণিজ্য থেকে অর্জিত অর্থে ভারী অস্ত্র–গোলাবারুদ সংগ্রহ করছে তারা, ফলে দিনদিন বাড়ছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আরাকান আর্মির আনুষ্ঠানিক আয়–উৎস নেই। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অর্থ জোগাতে তারা বাংলাদেশে মাদক ও অস্ত্র বিক্রি করে ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করছে। সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ না করলে পার্বত্য অঞ্চল নিরাপত্তা সংকটে পড়তে পারে।

দুর্গম পাহাড় ও নৌপথে অস্ত্র–মাদকের রুট

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ি এলাকা ও নাফ নদী অবৈধ অস্ত্র ও মাদক বেচাকেনার প্রধান রুটে পরিণত হয়েছে। বান্দরবানের ঘুমধুম, নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলীকদমসহ মিয়ানমার সীমান্তের অন্তত ১০০টি পয়েন্ট দিয়ে স্থলপথে অস্ত্র ও ইয়াবা ঢুকছে।

কক্সবাজারের টেকনাফ, ফিশারিঘাট, মুরুসকুল, মহেশখালী, আনোয়ারা, গহিরা, পতেঙ্গা—এমন বহু পয়েন্ট দিয়ে আসছে বড় বড় মাদকের চালান। এসব মাদক বরিশাল, চাঁদপুর ও খুলনার মোংলা সাগরপথ হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে দেশের বড় মাদক–অস্ত্র সিন্ডিকেটের হাতে। অবৈধ এসব বাণিজ্যের অর্থ সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হয়। ডলার ও মিয়ানমারের মুদ্রায় সেই টাকা পৌঁছে যায় আরাকান আর্মির সদস্যদের হাতে; আর এই অর্থেই কেনা হচ্ছে ভারী অস্ত্র।

সম্প্রতি পরিচয় গোপন রেখে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাদক–অস্ত্র চোরাচালান চক্রের এক সদস্য জানান, “বার্মা থেকে আরাকান আর্মি ইয়াবা ও অস্ত্র দেয়। নাফ নদী থেকে ট্রলারে কৌশলে তা তুলে নিতে হয়।”

চক্রের সদস্যরা জানান, প্রথমে সীমান্তঘেঁষা মাছের আড়ত থেকে ট্রলারে নদীপথে আনা হয়; এরপর সাগরপথ দিয়ে কয়েক ধাপে পৌঁছে দেওয়া হয় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে।

আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও চক্রের তথ্যমতে, আরাকান আর্মি বাংলাদেশমুখী সমুদ্ররুটকে দু’ভাগে ভাগ করেছে—সেন্ট মার্টিন–শাহপরীর দ্বীপ–নাফ চ্যানেল এবং কুয়াকাটা–রামনাবাদ–পাথরঘাটা করিডোর।

টেকনাফ স্থলবন্দর অচল করে মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ

প্রথমদিকে আরাকান আর্মি পণ্যবাহী জাহাজ থেকে খাদ্য লুট, টেকনাফের জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করলেও এখন তারা বড় অর্থের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসা। গত সাত মাস ধরে টেকনাফ স্থলবন্দর বন্ধ করে সাগরপথকে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে মাদক পাচারের জন্য। আগে প্রতি মাসে এই বন্দর দিয়ে ১২০ কোটি টাকার রাজস্ব পেত বাংলাদেশ।এখন বন্দর অচল রেখে সাগরপথে চলে জমজমাট মাদক বাণিজ্য।

আরাকান আর্মির অন্তত ২০টি সক্রিয় সিন্ডিকেট এ বাণিজ্যে জড়িত। এর মধ্যে ‘হোয়াই থিন’ ও ‘আইন সাইন’—এই দুই ব্যক্তির নাম প্রধান সিন্ডিকেটনেতা হিসেবে উঠে এসেছে।

সূত্র জানায়, মিয়ানমার–চীন সীমান্তের ওয়াফেনি ও এংন এলাকায় ইয়াবা তৈরির অন্তত ১৫টি কারখানা নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি। বড় কারবারিদের কাছ থেকে প্রতি কাটে ৮–১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।

১০ হাজার পিস ইয়াবা ১২–১৩ লাখ টাকায় আরাকান আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশি কারবারিদের হাতে জিরো পয়েন্টে পৌঁছে দিচ্ছে। বিজিবির তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত টেকনাফ সীমান্ত ও নাফ নদ দিয়ে পাচারের সময় ৩৬ লাখ ৩৬ হাজার ২০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে—বাজারমূল্য প্রায় ১০৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আট মাসে ৫৯টি মামলা ও ৪২ জন পাচারকারীকে আটক করা হয়।

জেলেদের অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়

বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়া বাংলাদেশি জেলেদের অপহরণও আরাকান আর্মির অন্যতম আয়ের উৎস। এখনও প্রায় ১৫০ জেলে তাদের হাতে বন্দি রয়েছে। গত ১১ মাসে নাফ নদ ও সংলগ্ন এলাকা থেকে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সবশেষ বুধবার সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে দুটি ট্রলারসহ ১৩ জেলেকে অপহরণ করেছে তারা। বিজিবি জানিয়েছে, কয়েক দফায় ২০০ জন জেলেকে ফেরত আনা হয়েছে; বাকিদের উদ্ধারে তৎপরতা চলছে।

নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আরাকান আর্মি নতুন ষড়যন্ত্র আঁটছে। খাগড়াছড়িতে এক মারমা ছাত্রীকে কথিত ধর্ষণের ঘটনায় ইউপিডিএফের তাণ্ডবের সময় আরাকান স্টুডেন্ট ফোরামের বিবৃতি, বান্দরবানের থানচিতে সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করে তাদের জলকেলি উৎসব আয়োজন—সবকিছুই তাদের সক্রিয়তার ইঙ্গিত দেয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাহাড়ি–বাঙালিদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে দীর্ঘদিন ধরে কৌশলে কাজ করছে আরাকান আর্মি। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে চেহারাগত ও ধর্মীয় মিল কাজে লাগিয়ে তারা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান অঞ্চলে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। অনেকেই সেখানে সংসার গড়ে তুলেছে, আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে নিজেদের রাজনৈতিক ও সামরিক অংশীদার হিসেবে উপস্থাপনের লক্ষ্য থেকে দেশকে রক্ষায় এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মতামত

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রাকিব হোসেন আরাকান আর্মিকে ঠেকাতে সময়োপযোগী কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। পাশাপাশি তিনি সীমান্ত নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তৌহিদুল ইসলাম মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সীমান্ত সুরক্ষা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া উচিত। বিজিবির উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সীমান্ত নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে দ্রুত কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

কোস্টগার্ডের টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাহমুদুল হাসান জানান, মাদক ও চোরাচালান রোধে বাংলাদেশের জলসীমা ঘিরে কঠোর টহল জোরদার করা হয়েছে।

টেকনাফ–২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, “টেকনাফ সীমান্ত ও নাফ নদ দিয়ে আমাদের বিশেষ অভিযান অব্যাহত আছে। কারবারিরা নতুন নতুন রুট ব্যবহার করছে—বিশেষ করে সমুদ্রপথে।”

তিনি আরও বলেন, “মাদক ঠেকাতে আমরা নিয়মিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুনর্মূল্যায়ন করছি এবং চোরাচালান প্রতিরোধে কার্যকর অভিযান চালাচ্ছি। আন্তর্জাতিক জলসীমায় নজরদারি দুর্বল থাকায় পাচারকারীরা সেটি কাজে লাগাচ্ছে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *